প্রসঙ্গতালাক ও কিছু কথা

  প্রসঙ্গতালাক ও কিছু কথা 


                           কেন্দ্রে বিজেপি জোট সরকার দ্বিতীয় বারের জন্য কায়েম হওয়ার পর থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন ইস্যুতে দলিত ও সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপর ধারাবাহিকভাবে অসহিষ্ণুতার আঘাত নেমে আসছে । দলিত ও মুসলিমদের নানা স্থানে পিটিয়ে হত্যা , বাবরি মসজিদের স্থানে বিতর্কিত রামমন্দির নির্মাণ , গো-রক্ষা , শিক্ষাক্ষেত্রে গৈরীকরণের পর এবার মুসলিম সমাজের তালাক নিয়ে বিচার ব্যাবস্থার উপর প্রভাব খাটানো শুরু হয়েছে । আর অত্যন্ত সুকৌশলে এই সুড়সুড়িটা ( প্ররোচনা ) দেওয়া হচ্ছে মুসলিম সমাজের মধ্যে লিঙ্গ বৈষম্য সৃষ্টি করে  বিভাজন তৈরি করার উদ্দেশ্যে , যা কিনা ' ডিভাইড এন্ড রুল  ' পলিসির নামান্তর । ঔপনিবেশিক ভারতে ব্রিটিশ সরকার এই বিভেদ নীতির দ্বারা দেশভাগ করেছিল , ইহুদি লবি ও পশ্চিম বিশ্বের চক্রান্তে ও পৃষ্ঠপোষকতায় এইরকম বিভেদনীতির দরুন মধ্যপ্রাচ্যসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ প্রকটতর  হচ্ছে এবং অসংখ্য নিরাপরাধ মানুষের মৃত্যু ঘটছে । উল্লেখ্য ইসলামি শাস্ত্রে (শতিয়ত) সুস্থ সাবালিকা নারী - সাবালক পুরুষের জন্য অবস্থাভেদে বিবাহ  -  ১. ওয়াজিব ( যা পালনীয় কর্তব্য, ফরজের পরে এর মর্যাদা ) , ২. সুন্নাত ( ফরজ ও ওয়াজিবের পর এর মর্যাদা , নবীওয়ালা কার্য ) , ৩. মাকরূহ ( হালাল বা বৈধের কাছাকাছি , অবৈধ নয় ), এই তিন প্রকারের হয়ে থাকে । বাস্তবসত্য , ইসলামী শরীয়তে বিবাহ একটি সামাজিক চুক্তি ( Social Contact ) যাহাতে উভয় পক্ষের অভিভাবকদের সম্মতিক্রমে বিবাহ করতে ইচ্ছুক একজন পুরুষ পাত্রের নিযুক্ত উকিলের মাধ্যমে দেওয়া বিবাহ প্রস্তাব যদি ২ জন  সাক্ষীর সম্মুখে কন্যাপাত্রী ৩ বার সম্মতি ( কবুল ) প্রদান করে , ঐ বিবাহের প্রস্তাব অর্থাৎ ইজাব কবুল করেন তখন একজন কাজী বা মৌলভী সাহেব নির্দিষ্ট ' দেন মোহর  ' এর ( হবু স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে দেয় অর্থ ) বিনিময়ে বিবাহের খুৎবা পাঠের মাধ্যমে নিকাহ ( বিবাহ ) পড়ান । কিন্তু কোনো প্রকার অলঙ্ঘনীয় কারনে যদি স্বামী - স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা বা সদ্ভাব একান্তই অসম্ভবপর হয়ে পড়ে বা প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে , কিংবা দুরারোগ্যভাবে সহবাসে অক্ষমতা দেখা দেয় , পরকীয়া প্রেম এসে যায় সেক্ষেত্রে ' দাম্পত্য সন্ত্রাস ' থেকে মুক্তির জন্য ইসলামী শরীয়াতে নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে ধাপে ধাপে তালাক প্রদানের বিধান আছে । একথা ধ্রুব সত্য ' দাম্পত্য সন্ত্রাস ' থেকে মুক্তির জন্য ইসলামি শরীয়াতের তালাক বা ডিভোর্স প্রথার অনুমোদন যুক্তিযুক্ত এবং বিজ্ঞানসম্মত । তাছাড়া একজন স্ত্রীও বিপরীতক্রমে , স্বামীকে ত্যাগ করতে পারেন , ইসলামি পরিভাষায় যাকে খুলা ( KHULA ) বলা হয় । উল্লেখ্য , ইসলামী শরীয়াতে বিবাহ বন্ধনকে উৎসাহিত করা হয়েছে আর তালাক প্রদানকে নিকৃষ্টতম হালাল ( বৈধ ) বলা হয়েছে । তাছাড়া আরও বলা হয়েছে তালাক প্রদান  করলে আল্লাহর আরশ বা সিংহাসন প্রকম্পিত হয় ।

                  উল্লেখ্য ভারতের শীর্ষ আদালত ২২শে আগস্ট , ২০১৭ তে তাৎক্ষণিক তিন তালাক অবৈধ ঘোষণা করেছে , পাঁচ সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চের বিচারপতিদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ( জাস্টিস কুরিয়ান জোসেফ , রোহিন্টন ফলি নরিম্যান এবং উদয় উমেশ ললিত ) রায়ের মাধ্যমে । কিন্তু এখানে মহামান্য বিচারপতিদের সর্বসম্মতিক্রমে রায়ের প্রতিফলন ঘটেনি । ডিভিশন বেঞ্চে সংখ্যালঘিষ্ঠ যাঁরা ( শিখ  প্রধান বিচারপতি জে. এস. কেহর. , মুসলিম সদস্য জাস্টিস এস. আব্দুল নাজির ) ভিন্ন মত পোষণ করেছেন , তাঁদের রায় আদালত তিন তালাককে অসাংবিধানিক বলতে পারেনা । কারণ ধর্ম হচ্ছে একটি বিশ্বাসের বিষয় , যুক্তির নয় । বিচারপতি নাজির বলেছেন তিন তালাক সংবিধানের ১৫ ধারার ( ধর্মাচারণের স্বাধীনতা ) অবিচ্ছেদ্য অংশ আর তাৎক্ষণিক তিন তালাক সংবিধানের ১৪ , ১৯ বা ২১ ধারা অমান্য করে না । জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের পশ্চিম বঙ্গ শাখার সভাপতি মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন - ' ধর্মীয় আইন ও  অধিকারে হস্তক্ষেপের ক্ষমতা সংবিধান কাউকে দেয়নি । সুক্ষভাবে বিচার করলে দেখা যায় ইসলামি শাস্ত্রে তাৎক্ষণিক তিন তালাক কঠোর শর্তসাপেক্ষ অর্থাৎ রাগের মাথায় , নেশাগ্রস্থ অবস্থায় , ফোন বা হোয়াটস আপের মাধ্যমে বা অন্যান্য কিছু ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় । সুতরাং , বর্তমান সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নতুনত্ব নেই , তবে বিষয়টা এক্তিয়ারের । আসলে এসবের অন্তরালে গভীর অভিসন্ধি হ'ল ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ভারতে গঠিত মুসলিমদের ধর্ম , কৃষ্টি - কালচার , সংস্কৃতি , সহায় - সম্পদ উত্তরাধিকার  রক্ষার্থে যে ' মুসলিম পার্সোনাল ল ' বোর্ড আছে তাকে পর্যায়ক্রমে কার্য ও ক্ষমতাহীন করে মুসলিম সমাজকে ইসলামি সাংস্কৃতিক দিক থেকে অভিভাবকহীন করা । সেইজন্য সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান রায়কে নরেন্দ্র মোদী সহ শাসক বি.জে.পি. দল , উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল আর.এস.এস. ও অন্যান্য কেহ কেহ ঐতিহাসিক রায়  বলে মত প্রকাশ করেছে । আসলে তাদের লক্ষ্য নানা ভাষা , নানা মতের দেশে অভিন্ন দেওয়ান বিধি চালু করার এজেন্ডা বাস্তবায়িত করা । ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা । সুতরাং দেশের সংবিধান ও বিচার ব্যাবস্থার প্রতি যথাযথ সম্মান ও আস্থা রেখেই বলা যায় শুধুমাত্র মুসলিম মেয়েদের তালাক নিয়ে কেন , জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সমগ্র নারী জাতির প্রতি লক্ষ্যটা দিলে অধিকতর মঙ্গল হতো না কী ? যেখানে দেশে প্রতিদিন নারী ধর্ষণ , কামধেনু-নির্ভয়া কান্ড , গুরুমিত রাম রহিম সিংয়ের কান্ড ঘটছে , কন্যা ভ্রূণ হত্যা , বধূ নির্যাতন , নাবালিকা বিবাহ , নারী পাচার , নারীদেহ ব্যবসা , পণের বলি , ডাইনি অপবাদে নারীহত্যা , পিতার সম্পত্তিতে মেয়ের অধিকার না দেওয়া , কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের উপর অশালীন আচরণ - ক্যান্সার ব্যাধির মতো সমাজকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে , সেখানে মুসলিম সমাজের নগন্য সংখ্যক কয়েকটা তালাক বা ডিভোর্সের ঘটনা নিয়ে এত ঢাকঢোল পেটানো কেন ? বরং নীতি-নৈতিকতা মূল্যবোধের শিক্ষা , কর্মসংস্থান , দারিদ্রতা দূরীকরণ ও মাতৃজাতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের চেতনা সৃষ্টি করতে পারলে ভালো হয় । যেখানে বাস্তবতা এই যে গুজরাটে মুসলিম নিধন চলে , পাইকারী হরে গণধর্ষণ সংগঠিত হয় , নারোদা পাৰ্টি যাতে গর্ভবতী কওসার বানুকে ধর্ষণ করে গর্ভের বাচ্চাকে তরবারির আগা দিয়ে পেট চিরে বার করে মা ও শিশুকে একসঙ্গে জ্বালিয়ে দিয়ে হত্যা করা হয় , গর্ভবতী বিলকিস বানুকে গণধর্ষণ করা হয় এবং তার স্বামী ও পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয় , সেখানে তালাক নিয়ে নয় , প্রয়োজন দলিত ও সংযালঘুদের ম্যান-সম্মান , ইজ্জত-আব্রু এবং জান ও মালের নিরাপত্তার স্বার্থে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ আইন ( Communal Riot Prevention Act ) । আর যদি সংযালঘু সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটানোর সদিচ্ছা থাকে তবে সেক্ষেত্রে সাচার কমিটির রিপোর্ট , রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন করতে হবে , এবং যদি সমাজ সংস্কারের ইচ্ছা থাকে তবে সেক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ' বর্ণভেদ প্রথা ' বিলোপ করে অব্রাহ্মণদেরকেও মন্দিরের পুরোহিতদের মতো পূজা-অর্চনা করার অধিকার দিতে হবে ।


ভালো লাগলে কমেন্ট করুন । অন্যকে জানাতে শেয়ার করুন । আরো আপডেট পেতে আমার ব্লগ কে সাবস্ক্রাইব  করুন ।  টুইটারে আমাকে  ফলো  করুন  ।

Comments

Popular posts from this blog

Solution To Rohingya Crisis

ANTI-MUSLIM RIOTS, AN ON GOING PROCESS OF COMMUNAL INDIA TO FACE

What's Modi's Thinking and Reality ?